শিক্ষা আনে আলো, শিক্ষা আনে মুক্তি, কিন্তু আলোর দিকে তাকাবো কখন..?

পেটে খিদে নিয়ে আর আলোর দিকে তাকানো হয় না, তখন অন্ধকার বরং অনেক শান্তির আশ্রয়, নিজের ক্ষুধার্ত মুখটা আর দেখতে হয় না অন্ধকারে

স্বাস্থ্য ভবনের সর্বশেষ (২০২৪–২৫) ডেটা অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে প্রসূতি মৃত্যুর হার জাতীয় গড়ের চেয়ে এখনও বেশি। স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেমের (SRS) ২০২০–২২ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতের সামগ্রিক মাতৃমৃত্যু অনুপাত (MMR) ৮৮ হলেও, পশ্চিমবঙ্গে তা ১০৫  / প্রতি লাখ জীবিত সন্তান প্রসবের নিরিখে

গাইনি ডিপার্টমেন্টে Internship চলাকালীন প্রান্তিক একটা বাচ্চা মেয়ের কথা মনে পড়ে , বয়স কমবেশি 12 বছর, দেখি মা হয়ে চলে এসেছে, জিগ্যেস করলাম বিয়ে কবে হয়েছে ? বললো এক বছর আগে, তারমানে ওই দশ এগারো বছর বয়স, কিন্তু ওর জরায়ু তো implantation জন্যে তৈরি ই হয় নি এই বয়সে ! স্বভাবতই বাচ্চার পুষ্টি বহন করার জন্য প্ল্যাসেন্টাও ঠিকভাবে তৈরি হয় নি, পরিনত হয়ে গিয়েছে একেকটা জলে ভরা আঙুর এর মত থোকা থোকা একটা জিনিসে, যেটাকে আমাদের ডাক্তারির ভাষায় বলা হয়, মোলার Pregnancy।

বাচ্চা তো হয়ই নি , উল্টে মায়ের জন্যে উপহার এনেছে এমন একটা বিপদজনক অবস্থা যেটা ভবিষ্যতে অকালে তার জরায়ু বাদ দেবার মতো কারণ তৈরি করতে পারে, মোলার Pregnancy প্রায় অনেকগুলো স্পেকট্রাম, একেকটা একেক রকম চিকিৎসা আর তার আউট্‌-কাম,
সে যাত্রায় তাকে বাঁচানো গিয়েছিল..

কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর এই প্রদীপের নিচে আঁধার কেন..? আজও বাবা মায়েদের কাছে, মাসিক শুরু হওয়া পর থেকে যুবতী মেয়েরা বোঝা বাদে কিছুই না । যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী নারী হলেও মেয়েরা সুরক্ষিত থাকেনা সেখানে বাবা মায়ের এই ভাবনা অমূলক ও বলা যাবে না

মানসিকতা টা অনেকটা এরকম যে – পড়াশোনা করে এমনিতেও কিছু হবে না, তার চেয়ে একটা উপার্জনকারী পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দিলে দুরকম দায় থেকেই মুক্তি – পড়ানোর ঝামেলা নেই, খাওয়ানোর ও, তার ওপর একটা সম্পর্কও পেল। বছর ঘুরতেই এরাই হয়ে যায় মা, যার নিজের কৈশোর কাটেনি, সেই আরেকটা শিশুর দায়িত্বে!

পরিসংখ্যান বলছে মুর্শিদাবাদে বাল্যবিবাহের হার অন্যান্য জেলার থেকে বেশি। এমনকি, স্বাস্থ্য দফতরের নথি থেকেও জানা যায়, ওই জেলা নাবালিকা প্রসূতির সংখ্যার হিসেবেও রাজ্যের মধ্যে সর্বাধিক

স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, উদ্বেগের তালিকায় প্রথম তিনে  মুর্শিদাবাদ, রামপুরহাট (স্বাস্থ্য জেলা) ও বীরভূম। পাশাপাশি, আরও ১৪টি জেলায় নাবালিকা প্রসূতির সংখ্যা বাড়ছে বলেই পর্যবেক্ষণ  স্বাস্থ্যকর্তাদের।প্রতি বছর এ রাজ্যে যত প্রসূতি-মৃত্যু হয়, তার অন্তত ১৪ শতাংশই সেই নাবালিকা প্রসূতি..

এই সমস্যা শুধু নিছক স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান নয়, এটি এক গভীর সামাজিক সংকেতও। একদিকে নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের পরিবারের মায়েরা খিদে সামলে সংসার চালান, পুষ্টির মারাত্মক ঘাটতি, অন্যদিকে একই অপুষ্ট শরীর নিয়ে বারবার সন্তানের জন্ম দেওয়া

একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য পুষ্টি, সঠিক যত্ন আর নিরাপদ প্রসবের পরিবেশই তার জন্য ‘আলো’। কিন্তু যখন দারিদ্র্য, অপুষ্টি এবং সুপরিকল্পিত স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অভাব আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে, তখন সেই ‘আলো’ কেবল দূর আকাশের তারা হয়েই টিম টিম করে

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য একে অপরের পরিপূরক । যখন নারীরা সত্যিকার শিক্ষিত হয়, তখন তারা নিজের শরীর সম্পর্কেও সচেতন হয়, সময়মতো চিকিৎসা নেয় এবং সমাজেও পরিবর্তনের জোয়ার আসে ।

যে ভূমি ‘শিক্ষা আনে আলো, শিক্ষা আনে মুক্তি’র শ্লোক আওড়ায়, সেই মাটিতেই যখন হাজার প্রকল্পের পরেও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এক অন্ধকার তার শীতল থাবা বিস্তার করে, তখন আলো আর মুক্তির প্রতিজ্ঞাগুলি কেমন যেন উপহাসের মতো শোনায় ।

প্রসূতি মৃত্যুকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে গেলে উপযুক্ত পরিকাঠামোর হাসপাতালের সংখ্যা আরও বাড়াতে তো হবেই, প্রয়োজন সমাজের নিম্নতম স্তরের মায়েদের অপুষ্টির বিপরীতে খাদ্যের নিরাপত্তা, প্রাক-প্রসবকালীন (Antenatal) সঠিক চেক আপ এবং প্রসবকালীন চিকিৎসা ব্যবস্থার শক্তিশালীকরণ

– ডা. কাজী ফাইয়ায আহমদ

Scroll to Top