আমাদের মতো যারা জেলার কোনো এক অখ্যাত গ্রাম, মফঃস্বল এর বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো থেকে পড়াশোনা করে আজকে কলকাতা বা কলকাতা ছাপিয়ে রাজ্য বা দেশের বাইরে ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, জেনারেল ডিগ্রি নিয়ে পড়ছে কিংবা গবেষণা, চাকরিবাকরি করছে, তারা জানে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল ইট-কাঠের কাঠামো ছিল না, ছিল এক-একটি বোধিবৃক্ষ। ওগুলো ছিল অন্যের হক না মেরে খেটে খাওয়া বাঙালির স্বপ্ন দেখার, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শেষ আশ্রয়
ভারতীয় সংস্কৃতি যুগ-যুগান্ত ধরে শিক্ষককে ‘আচার্য’ রূপে চিনেছে । তিনি শুধু জ্ঞান দান করেন না, আপন আচরণের মাধ্যমে ছাত্রদের নৈতিক ভাবে জীবনযাপনের পথটি দেখান.. আমরা আমাদের সেই বাঙলা মিডিয়ামে পড়ানো শিক্ষকদেরই একেকটা আদর্শিক ক্ষুদ্র সংস্করণ । আমাদের শিক্ষকরা আমাদের কেবল পাঠ্যপুস্তক শেখাননি; তাঁরা আপন আচরণের মাধ্যমে শিখিয়েছিলেন জীবনযাপনের নৈতিক পথ ।
কিন্তু শেষ দশ বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে যত অন্যায়ের অন্ধকার ঘনিয়েছে, ততই কালিমালিপ্ত হয়েছে শিক্ষকের ভাবমূর্তি।রাজ্যে শিক্ষকতার যোগ্যতার অন্যতম মাপকাঠি জ্ঞানের সাধনা নয়, হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক আনুগত্য, টাকা দিয়ে চাকরি কেনা/বিক্রি, একটার পর একটা বাংলা মিডিয়াম স্কুল বন্ধ হয়েছে, কৌলীন্য হারিয়েছে প্রান্তিক স্কুল গুলোর ওপর ভরসা করে থাকা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত বাঙালির মেধা ও অমানুষিক অস্তিত্বরক্ষার পরিশ্রম
বিদ্যার মহিমায় যে গুরুর সর্বত্র পূজিত হওয়ার কথা, এখন ‘শিক্ষক’ বলতে আর কোনও শ্রদ্ধেয় ছবি মনে আসে না, যাদের নাম আজও আসে তারা হয় কেউ পৃথিবী ছেড়েছেন, নতুবা অবসরপ্রাপ্ত, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী ?
অবশ্য শিক্ষকদের ও দোষ দেয়া যায় না , শিক্ষকরাও এই সময়েরই ফসল, এই গলিত-স্খলিত সমাজেরই অঙ্গ । যে সমাজে দুর্নীতি, অন্যায় আর নৈতিক স্খলন সর্বব্যাপী, সেই সমাজের প্রাণকেন্দ্র— শিক্ষাব্যবস্থা— তার বিষ থেকে মুক্ত থাকবে কী করে?
যে বটবৃক্ষের ছায়ায় জীবনের প্রথম আলো দেখা, আজ সেই শিকড়েই ধরেছে পচন, সেই মন্দিরে লালবাতি, এ যেন এক গোটা প্রজন্মের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ..যে জাতি তার আচার্যকে সম্মান দিতে জানে না, যে সমাজ তার বোধিবৃক্ষের ছায়া বিক্রি করে দেয়, সে জাতি আসলে তার ভবিষ্যৎ বিক্রি করে দেয়, এর চেয়ে অভাগা জাতি আর কে আছে ।
– ডা. কাজী ফাইয়ায আহমদ




